কাজের সূত্রে এবার চললাম মস্কো। এর আগেও বার কয়েক গিয়েছি, ঘটনাচক্রে তা জুন-জুলাই ছিল। এবার জানুয়ারীর শুরুতে যেতেহচ্ছে ভেবে গুগল খুলে টেম্পারেচার দেখতে গেলাম। দেখে হার্টে একটা চিনচিন অনুভব করলাম, মাইনাস টোয়েন্টি এইট ডিগ্রী সেলসিয়াস। রিয়েলি? আর ইউ সিরিয়াস!! চোখে ভুল দেখছি কি? কচলে, মচলে আবার দেখি, মাইনাস টোয়েন্টি এইট। এবার চোখে সর্ষের ফুল, সব যেন ধোঁয়া ধোঁয়া। সবকিছুরই সেকেন্ড ওপিনিয়ন নেওয়া বাঙালির রক্তে। গুগলকে অবিশ্বাস করার ধৃষ্টতা দেখালাম, আরও বার দশেক অন্য সাইট চেক করলাম, ড্যাম, একই রেজাল্ট। প্লাস ফিফটিনের কলকাতায় বসে মাইনাস টোয়েন্টি এইট কল্পনা করা অসম্ভব জেনেও চেষ্টা করতে গিয়ে ভীষণ বিষম খেলাম। হার্টে চিনচিনের সাথে এবার মাথা ভোঁ ভোঁ, পেট গুড় গুড় শুরু হলো। টেম্পারেচার এনালিসিস করতে গিয়ে জানলাম রাশিয়া পৃথিবীর শীততম দেশগুলির মধ্যে একটি। যাই হোক যেতে যখন হবেই, ভাণ্ডার খুঁজে বার করা গেলো যেসব শীতের পোশাক যারা এতদিন ন্যাপথলিনের আবেশে মাখা, যারা আলোরমুখ দেখেনি বহু শতক হয়ে গেলো। কলকাতাতে নেহাতই তাদের গুণের কদর ছিল না। এবার পূর্ণ মর্যাদা পাবে বুঝে তারাও বেশ ফুলে-ফেঁপে।
দুটি নিতেই বাক্স পেটরা ফুল। তার পরে বেশ টেনশনের রাতগুলো কাটিয়ে পোঁছলাম "মস্কোভা"। এয়ারপোর্টে পৌঁছে বোঝার উপায় নেই বাইরে কি অপেক্ষা করছে। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বাইরে আসতে আসতেই রাত, মানে টেকনিক্যালি সকাল ২:৩০. টম ক্রুসের লুকওয়ালা ড্রাইভার আমার নামওয়ালা সাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিজেকে এঞ্জেলিনা মনে হলো। গটগট করে এগিয়ে গেলাম, বলতে পারেন ভেসে গেলাম। হঠাৎ মনে পড়লো ক্যাশ চাই। ঠান্ডার ডান্ডাতে বাকি সব ভুলেছি। কার্ডটা ভুলিনি ভাগ্যিস। সামনেই ৪ টি এটিএম মেশিন। বীরবিক্রমে এগিয়ে গেলাম | টম করুইস আমার ব্যাগটি নিয়ে আমাকে খানিক বোঝা মুক্ত করে বাধ্য ছেলের মতো পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। এটিএম এ কার্ড ঢুকিয়ে এদিক ওদিক টেপাটেপি করতেই দুমদাম রাশিয়ান ফরফে কি সব এসে সব শান্ত। এক সেকেন্ড - দু সেকেন্ড - তিন - চার - পাঁচ -ছয় শান্ত। ইতনা সন্নাটা কিউ হ্যায় ভাই! মানে? টাকা? কার্ড? টাকা বেরোলো না। কার্ডও না। অসহায় চোখে তাকাই এদিক ওদিক। ক্যানসেল টেপাটেপি করি, নাথিং।মানেটা যা দাঁড়ালো তা হলো এটিএম এর খিদে পেয়েছিলো মাঝরাতে, বাঙালির যেমন পায়, ফ্রীজে রাখা মিষ্টির খিদে। এরও পেয়েছিলো, খেয়ে নিলো আমার কার্ড। আমার ততক্ষনে মাথায় হাত, চোখ কপালে এবং আর যা যা কিছু ওপরে ওঠা বা নিচে নামা সম্ভব। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসে প্রায়, টমবাবু আন্দাজ করে ছুটে আসে। কিন্তু রাশিয়ার অধিকাংশের মতো উনিও ইংরিজি বলেন না। নানা অঙ্গ-ভঙ্গি হলো, আসেপাশের অনেকে এসে আরো টেপাটেপি করলেন। এটিমের বোধহয় ততক্ষনে খাবার স্টমাক পেরিয়ে ইন্টেস্টাইনে। নো মোর আশা। প্রায় কেঁদে ফেলবো এই সময়ে, হঠাৎ দেখি টম নেই। হাওয়া। জাস্ট ভ্যানিশ। ব্যাগটা? আমার ব্যাগটা? তাও নেই। ধপ করে বসে পড়লাম। হায় ! মনুষ্যত্ব হারানোর কম্পেটিশনে এরাও তাহলে প্রতিযোগিতায়। নিজেকে অসহায় মনে হলো। কি করবো, কি করা উচিত, এসব ভাবার মানসিক স্থিতি তখন হারিয়েছি।
একটা শুন্যতা। ব্ল্যান্ক। এমটিনেস। গলা ছেড়ে কাঁদতে পারলে ভালো লাগবে মনে হলো। কিন্তু না, আমরা শহুরে সভ্য আর্বানীটির তত্ত্বাবধানে অভ্যস্ত। বেসামাল হলে চলবে না। হাসি পেলে মুখ টিপে। কান্না পেলে লুকিয়ে। কলকাতা হলে এতক্ষনে একটা মিনি ঝাঁক তৈরী হতো আমাকে ঘিরে। এখানে কারোর সময় নেই। মাঝরাতে এমনিতেই সবাই হয় ক্লান্ত নাহয় ব্যস্ত। বোধহয় মিনিট দু-তিনেক ওভাবেই বসে। শক্তি কিছু জড়ো করে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটির কাছে গেলাম। ভাঙা ইংলিশ বলে তারা। বোঝার চেষ্টা করছে যথা সম্ভব। আমি তত ধৈর্য্য হারাচ্ছি। মনে মনে কি কি গালাগালি দেব সেটা সাজাচ্ছি। ঠিক করলাম চারিদিকে জানাবো এই ঘটনা, এই অরাজকতার ব্যাপারে। তোলপাড় করে দেব পৃথিবী। উড়িয়ে দেব, ভাসিয়ে দেব, আমি ঝঞ্ঝা,আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি। ফাটিয়ে ..... আরে ওই তো ওই তো টম করুইস, ওই তো। পালাচ্ছে নাকি আমার দিকেই আসছে? হ্যা আমার দিকেই। হাতে ব্যাগটাও আছে। হাঁফাতে হাঁফাতে ইশারায় বোঝাল, ওই এটিএম যে ব্যাংকের, তার অফিস দোতালায়। টম করুইস ওখানেই ছুটেছিল। কিন্তু এতো রাতে তাদের ব্যাংকের কোনো লোক নেই। আরও অনেক কিছু বোঝাতে চাইলেও পারছিল না, তাই সাথে নিয়ে এসেছে আধো ইংরিজি বলা পথ চলতি প্যাসেঞ্জারকে। প্যাসেঞ্জার ভদ্রলোকটি সমস্তটা মন দিয়ে শুনলেন এবং বেশ কটা পটাপট ফোন করলেন, সাদা কাগজে খসখস লিখে দিলেন একটা ঠিকানা আর আমাকে জানালেন, উপযুক্ত প্রমানসহ আগামীকাল এই ঠিকানায় গেলেই পাওয়া যাবে রিপ্লেসড কার্ড। ঠিকানাটি ওই ব্যাংকের মেইন অফিস। আর টম বাবাজির গাড়ি ভাড়া টাকা নাকি পরে দিলেও চলবে। এবার চোখের জল আর আর্বানীটি ধরে রাখতে পারলো না। কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো।
Subir Adhicary
posted on March 24, 2019 6:30:28 PM IST